প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাই। আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে গড়তে চাই। আজকের শিশুরাই হবে সেই স্মার্ট জনগোষ্ঠী, যারা এই দেশটকে গড়ে তুলবে। কাজেই আজকের এই শিশু দিবসের যে প্রতিপাদ্য বিষয় সেটা অত্যান্ত চমৎকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনের পতিপাদ্য হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুদের চোখ সমৃদ্ধি রঙে রঙ্গিন।’ আমি অত্যান্ত ধন্যবাদ জানাই মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এরকম একটি উপযোগী প্রতিপাদ্য গ্রহণ করার জন্য।
শুক্রবার(১৭ মার্চ) দুপুরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩ তম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত শিশু সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের কল্যাণে তার সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে এদেশের শিশুদের কথা বিবেচনা করেছে। শিশুদের দিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ণ করেছে। আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০, বাংলাদেশ কল্যাণ আইন ২০০১ প্রণয়ন করি। পরবর্তীতে আবার যখন আমরা সরকারে আসি আমরা এই দেশে শিশুদের জন্য জাতীয় শিশুনীতি ২০১০, পারিবারিক সহিংসতা সুরক্ষা আইন ২০১০, জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশু খাদ্য বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য উভয় ব্যবহারের সরঞ্জামাদি বিপণন নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছি।
প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা করার জন্য আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, নারী ও শিশুর প্রতি হিংসা ও সহিংসতা প্রতিরোধে জন্য কর্মপরিকল্পনা ২০১৩ থেকে ২০২৫, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন ২০১৮, বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে জাতীয় মহাপরিকল্প ২০১৮ থেকে ২০৩০ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন সংশোধিত আইন ২০২০ প্রণয়ন করে নারী ও শিশুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি।
আমরা জাতির পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করে ২৬ হাজার ১৯৯টি সরকারি রেজিষ্ট্রার্ড ও কমিউনিটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করে দিয়েছি। আমরা শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বই দিয়েছি, শুধু তাই নয় আমরা প্রাথমিক শিক্ষার্থী ১ কোটি ২০ লাখ শিশুকে উপবৃত্তি দিচ্ছি। যা সরাসরি শিশুদের মায়ের নামে সেই টাকা যাচ্ছে। আর সব মিলে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী আমাদের কাছ থেকে বৃত্তি ও উপবৃত্তি পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, টুঙ্গিপাড়া জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। এই মাটিতেই তিনি জন্ম নিয়েছেন, বড় হয়েছেন। এখানকার মাটিতেই তিনি শায়িত আছেন। নিজের জীবনটাকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য। তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন থেকেই দরিদ্র কোনো ছেলে যার বই নেই তাকে নিজের বই দিয়ে দিতেন। নিজের গায়ের কাপড় খুলেও দরিদ্র মানুষকে বিলিয়ে দিতেন। এমনকি দুর্ভিক্ষের সময় নিজেদের গোলার ধান পর্যন্ত মানুষকে বিলিয়ে দিতেন। তার (বঙ্গবন্ধু) ভেতর সেই মানবিকতা ছোট বেলা থেকেই আমার দাদা-দাদি লক্ষ্য করেছেন।
বড় হয়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) এদেশের যারা একেবারেই শোষিত, বঞ্চিত ছিলেন, যারা এক বেলা খাবার পেতেন না, যাদের শরীরে কোনো পুষ্টি ছিল না, রোগে চিকিৎসা পেতেন না, ঘরবাড়ি ছিল না সেই সব মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্যই সংগ্রাম করেছেন। আমরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারি, বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি, সেই ৪৮ সাল থেকেই তিনিই আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তারই নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, স্বাধীন জাতি হিসাবে আত্মপরিচয়। কাজেই জাতির পিতার এ জন্মদিনটিকে আমরা শিশু দিবস হিসেবেই ঘোষণা করেছি।
শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের হাতে নতুন বই তুলে দিচ্ছি, যাতে তারা পড়াশোনায় মানোযোগ দেয়। আমরা কম্পিউটার শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছি। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য দরকার স্মার্ট জনগোষ্ঠী। শিশুকাল থেকেই শিশুরা যেন কম্পিউটার শেখে সেই ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি এবং প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে কম্পিউটার কোডিং পদ্ধতি শেখানো কার্যক্রমে ব্লেডিং অ্যাপ্রোচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দক্ষতা বিকাশে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তার আদর্শ আমাদের মধ্যে আছে। সেই আদর্শ নিয়েই বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাবো। আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশের কোনো শিশুই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবে না। কোন মানুষই ভূমিহীন, গৃহহীন থাকবে না। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হবে না। প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে এই দেশকে উন্নতভাবে গড়ে তুলবো।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, সবাইকে অত্যান্ত মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন হতে হবে। যারা প্রতিবন্ধী বা অক্ষম তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। ‘অন্ধকে অন্ধ বলিও না, পঙ্গুকে পঙ্গু বলিও না’, এটা তো ছোট বেলার শিক্ষা। কাজেই তাদের প্রতি আরও সদয় হতে হবে। আমরা কিন্তু প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেই, প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদাভাবে বৃত্তিও দিয়ে থাকি। কাজেই সবাই এই সমাজের।
শিশুদের খেলাধুলা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভালবাসতেন। শিশুদের জন্যই তার অত্যান্ত দরদ ছিল। শিশুদের সঙ্গে খেলা করতেও তিনি পছন্দ করতেন। কাজেই এই জন্য তার জন্মদিনটাকে জাতীয় শিশু দিবস হিসাবেই ঘোষণা করেছি। শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যত। তারা যেন অত্যান্ত যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠে সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী শিশুদেরকে খেলাধুলার উপর নজর দেবার আহবান জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফুটবল খেলতেন। আমার দাদাও খেলতেন, আমর ভাইয়েরা তো খেলতেনই, আমাদের ছেলে মেয়েরা ও নাতি পুতিরও ফুটবল খেলেন। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ছেলে মেয়ে উভয় থেকে শুরু করে একেবারে ইউনিভারসিটি পর্যন্ত আন্তস্কুল, আন্তকলেজ, আন্তবিশ্ববিদ্যালয় খেলাধুলার প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমাদের ছেলে মেয়েরা খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করলে শরীর ভালো থাকবে, মন ভালো থাকবে এবং সবারই একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে গড়ে উঠবে সেটাই আমি চাই। মানুষের জন্য কিছু করা, মানুষের জন্য ত্যাগ করা এটা মহৎ একটা কাজ। জাতির পিতাই বলেছেন, মহৎ অর্জনের জন্য মহান ত্যাগ প্রয়োজন।
শিশু স্নেহা ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শিশু সমাবেশে শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল, শিশু প্রতিনিধি স্বপ্নিল বিশ্বাস বক্তব্য রাখেন।
এর আগে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী পুস্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি। এসময় তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে, বেজে ওঠে বিগউলের সুর। পরে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের শহিদ সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাত অংশ নেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
এসময় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শাজাহান খান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, শেখ হেলাল উদ্দিন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাসিম, শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল, কেন্দ্রীয় সংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আযম, এস.এম কামাল হোসেনসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পর সকাল পৌনে ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগে দেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতার পুরস্কার ও দুঃস্থ মেধাবী শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুদান বিতরণ করেন। একই সঙ্গে তিন দিনব্যাপী বই মেলার উদ্ধোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। সব কর্মসূচি শেষ করে বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার উদ্দেশ্যে টুঙ্গিপাড়া ত্যাগ করেন।